আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করেন কেমন আছেন ? বেশিরভাগ মানুষ উত্তরে বলে ভালো আছি। আসলেই কি ভাল আছে??🤔আমরা বেশিরভাগ সময় কোন না কোন কারণে প্রচন্ড পরিমাণে রাগন্দিত, আতংকিত বা প্রচন্ড মানসিক চাপ এ থাকি।অথবা,,,,কোনো কারনে কস্ট পেয়ে থাকি। কিন্তু তারপরও আমরা মুখে বলি আমরা ভাল আছি। আপনি বা আপনার পরিবার কোন না কোন কারনে.. তা পারিবারিক হোক, সামাজিকভাবে হোক অর্থনৈতিকভাবে হোক বা আবেগজনিত কারনে হোক অথবা কোন কিছু পাওয়া না পাওয়ার কারনে মানসিক চাপের মুখে থাকে, অস্থিরতায় থাকে বা আতংকিত থাকে....এই আতংকিত, ভয়,চাপ যখন থাকে তখন মানুষের মনের ভিতর একটা বড় পরিবর্তন হয়।আর সেই পরিবর্তন থেকে হতে পারে সুইসাইড,খুন এবং অসামাজিক কর্মকান্ড।
আর তাই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে এবং কখন কি করণীয় তা জানতে হবে।
আমরা যখন দেখি আমাদের স্বাভাবিক কাজগুলি ব্যাহত হচ্ছে তখনি মানসিক অসুস্থতার প্রশ্নটি সামনে আসে। দেখা যায় যে ,আমরা শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে যতটা সচেতন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ততটা সচেতনতা দেখাই না। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে তা শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের মন, আচরণগত ও আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্যের দিকটি।আমরা কি চিন্তা করি, কি অনুভব করি এবং জীবনকে সামলাতে কিরকম ব্যবহার করি এগুলোই আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য।একজন মানসিক ভাবে সুস্থ মানুষ নিজের সম্পর্কে ভালো ভাবে এবং কখনোই কিছু আবেগ যেমন রাগ, ভয়, হিংসা, অপরাধবোধ বা উদ্বেগ দ্বারা আবিষ্ট হবেনা।জীবনে যখন যেরকম চাহিদা আসে তা সামলে নেওয়ার ক্ষমতা তারা রাখে।মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই।এককথায় মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায়
"Full and harmonious functioning of whole personality."
মনে রাখবেন ঠিক যেমন যে কারুর ঠান্ডা বা ফ্লু লাগতে পারে, তেমনি যে কেউ মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে যখন তাদের জীবনে কোনো চাপ বা উদ্বেগের মতো কঠিন সময় আসে।
বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার সেকেন্ড ওয়েব আসবে আর সেটা হবে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক। তাই মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা করোনা মহামারির মতো বৈশ্বিক সমস্যা। করোনার করাল গ্রাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য ঝুঁকি, প্রিয়জন হারানোর ভয়, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ইত্যাদির ফলে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে।
একটি জরিপে দেখা গেছে, পৃথিবীতে ৪০ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপে রয়েছে এই মহামারির প্রভাবে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, উচ্চরক্তচাপ বেড়ে যায়, বুক ধড়ফড় করে, ব্যথা ব্যথা করে, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, শ্বাস নিতে সমস্যা হয়, কোনো কিছুতে মন বসে না, খাওয়ার রুচি কমে যায়, বিষণ্নতা বেড়ে যায়, কর্মদক্ষতা হারিয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস কমে যায়, অস্থিরতা বাড়ে, সহজ বিষয়কে সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। ফলে একদিকে যেমন নিজের কর্মদক্ষতা কমে যায় ঠিক তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যর ওপর গুরুত্ব দিলেও আমাদের দেশে কোনো এক অদ্ভুত কারণে মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা নিয়ে মানুষের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যা চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। সামাজিক কুসংস্কারের কারণে অনেকে রোগ গোপন করার চেষ্টা করে।
২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা যায়, প্রায় ১৭% মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যায় ভুগছে; যার মধ্যে ৯৪ শতাংশ কোনো চিকিৎসা নেয় না।দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২কোটি মানুষই মানসিক সমস্যার মোকাবিলা করে যাচ্ছে।দেশে ১০০ জন এ প্রায় ৭জনই বিষন্নতায় আক্রান্ত।অবাক বিষয় হলো,এর ৯০%-চিকিৎসা আওতার বাইরে।এই সমস্যায় শিশুরাও কম আক্রান্ত নয়।দেশের ১৩.৬% শিশু কোনো না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে।এদের মধ্যে চিকিৎসা পাচ্ছে না ৯৪% শিশুই!!শিশু- কিশোরের মানসিক সুস্বাস্থ্যর এই অবনতির মূল কারণ আমদের অবজ্ঞা। এই মহামারিতে মানসিক রোগীর সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়। সারা দিন বাড়িতে বসে থেকে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব পড়ছে, যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই জরিপ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে,আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে যতটুকু সচেতনতা প্রয়োজন,ততটুকু সচেতন আমরা নই।বাস্তবিকই এখনো সমাজের প্রতিটি স্তরে মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা ঠাট্টা করি!হাসি-তামাশার মধ্য আমরা মানুষকে 'সাইকো','ম্যানিক','পাগল','স্ক্রু-ঢিলা', 'তারছিরা'বা আরও অনেক বাজে মন্তব্য করে থাকি!!!অথবা,মানসিক সমস্যাটাকে ছোট করে দেখি,,,আমাদের ধারণা মেডিকেলের পিছিয়ে যাওয়া মানুষরাই সাইকিয়াট্রিস্ট হয়।আমরা এই কথাগুলো যে শুধু নিজেরা বিশ্বাস করি তাই নয় বরং এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি সবার মাঝে!!ফলে ভিক্টিম সাহায্য না পেয়ে এই মানসিক অবসাদ থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিচার্স এর জরিপ এ দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার লোক আত্মহত্যা করেন, যাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি৷ বয়সের হিসেবে তরুণ-তরুণীরাই বেশি আত্মঘাতী হচ্ছেন৷ তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন এরচেয়ে আরো ১০ গুণ বেশি মানুষ৷চিকিৎসকেরা বলছেন, যাঁরা আত্মহত্যা করেন তাঁদের ৯৫ ভাগই কোনো না-কোনো মানসিক সমস্যায় ভোগেন৷
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা জানিয়েছেন যে, কিছু বদ্ধমূল সামাজিক ধারণার কারণে এখনও অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে পেশাদার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না।আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনতা বড় উদ্বেগের বিষয়। কথায় আছে,
"Prevention is better than cure."
এ দেশে মানসিক রোগ নিয়ে পড়াশোনা করলেও অনেকে পেশা হিসেবে এটাকে কেউ নিতে চায় না। ফলে প্রতি দুই লাখ মানুষের জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট রয়েছেন মাত্র একজন। আবার অনেক চিকিৎসক বোঝেন না যে, মানুষটি মানসিক রোগে আক্রান্ত। ফলে রোগী ব্যাপক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
তাই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন সভা, সেমিনার ছাড়াও গণমাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে।সরকারিভাবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরিধি বাড়াতে হবে। শারীরিক স্বাস্থ্যের মতো মানসিক স্বাস্থ্যও গুরুত্বপূর্ণ, এই বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে। বিশেষজ্ঞদের শহরকেন্দ্রিক প্রবণতা থেকে বের করে আনতে হবে।করোনা মহামারির সেকেন্ড ওয়েব মোকাবিলা করতে সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। কোনোভাবেই চাপ নেওয়া যাবে না। এই বিশাল অবসরকে উপভোগ্য করে তুলতে হবে। সুস্থ পৃথিবীতে কাজের চাপে হয়তো প্রিয় বই কিংবা প্রিয় সিনেমাটা দেখা হয়ে ওঠেনি এই বিশাল অবসরে, না করা কাজগুলো করে ফেলতে হবে। আশা রাখতে হবে এই দুর্দিনের শেষ হয়ে সুদিনের দেখা মিলবে।
ডেমো আর্টিকেল - ক্রেডিট: মেন্টাল হেলথ কেয়ার
Article by Jannatur Nur Samanta,
Ispahani Public School and College (HSCBatch-2k22)